॥ বিজয়া ॥ চলে যায়। ভেসে যায়।

॥ বিজয়া ॥


যে ছেলের নতুন জামা হয়নি, তার বাবা তাকে বলেছিল পুজোয় মন দিয়ে বেলুন বিক্রি করতে। ভালো বিক্রি হলে কালীপুজোয় সে পাবেই পাবে নতুন জামা। সে স্বপ্ন চোখে নিয়ে কলকাতার কত কত পথে সে হেঁটেছে আকাশে উড়িয়ে রঙবেরঙের বেলুনের সারি। লুব্ধ ক্লান্ত রাতজাগা চোখে এগিয়ে গেছে বাতানুকুল গাড়ির কাচের কাছে। হাত দিয়ে ডেকে ডেকে কত বলেছে বেলুন নেওয়ার কথা। তবে এ পুজোয় সে শিখেছে, গাড়ি নয়, সবচেয়ে বেশি বেলুন নেয় বাইকে চড়া মানুষগুলি। যুবকটি কিনে যুবতীটির হাতে ধরিয়ে দেয়। তারপর হুশ্ করে বাইক ছুটে যায় পথ বেয়ে। হাওয়ায় উড়তে থাকে লাল নীল হলুদ বেলুনগুলি। দশটি টাকা জমা হয় ছেলেটির থলিতে। দুর্গাপুজোয় তো সবাই পরে, কালীপুজোয় তার নতুন জামা কিনে দেবে বাবা, ভাবে মনে মনে। 

ঝাললমুড়ির ঝুড়ি নিয়ে দ্বিতীয়ার দিন থেকে পথে বেরিয়েছে ছেলেটি। নতুন বউ তার বড় অভিমানী। বাপ মায়ের কাছে কোন মুখে বলবে সে যে বিয়ের পর প্রথম বছর তার বর তাকে একটা ছাপা শাড়িও কিনে দেয়নি? কথা বলেনি সে মহালয়ার দিন থেকে। কথা দিয়েছে অষ্টমীর দিন আনবে টিয়াপাখি সবুজ শাড়ি। আলোর মালায় যখন জ্বলে ওঠে মন্ডপ, তাতে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। সে আলোয় দেখা যায় না তার চোখের কোণায় চিকচিকে জলটুকু। সে জল সবুজ শাড়িটির স্বপ্নে বিভোর। 

মেদিনীপুর থেকে শহরে এসেছে সদ্য গোঁফ ওঠা যুবকটি। প্যান্ডেল বাঁধে সে। আজকাল আর নারকেল দড়ি নয়, রঙীন কাপড়ের টুকরো পেঁচিয়ে বাঁশ বাঁধা হয়। এবার বর্ষা বড় নিঠুর। ওপরে উঠতে ভয় লাগে ভিজে পিছল বাঁশ বেয়ে। তবু সে ওঠে তিনতলা চারতলা সমান। ওপর থেকে মানুষের মাথা দেখে। এত মানুষের শহর, সেখানে সে আসে তার খিদে মেটাতে। বাপ মা গ্রামে পথ চেয়ে বসে আছে। সে ফিরলে কয়দিন তারা পেটপুরে ভাত খাবে। তাদের পুজো শুরু শহরের পুজোর শেষে। যখন হাত পিছলে যায়, সে দুহাতে শক্ত করে ধরে সামনে যা পায়। সে পড়লে সে একা মরবে না, তার সাথে মরবে আরো দুটি মানুষ মেদিনীপুরের অচিন গ্রামে। সে বেয়ে ওঠে আরো উঁচুতে। আরো ছোট হয় মাথাগুলি। 

লক্ষ্মীকান্তপুর থেকে যে ট্রেন এসে থামে বালিগঞ্জ স্টেশনে, তাতে ভোরেও উপচে পড়ে ভিড়। সবাই যখন শহরে পুজো দেখতে আসে, তখন সে ভিড়ের মধ্যে কোথায় হারিয়ে যায় মেয়েটি। কত অযাচিত স্পর্শ, কত কনুইয়ের গুঁতো, কত বিদ্বেষের চাহনি সে এতদিনে উপেক্ষা করতে শিখে গেছে। সেদিন সে দেখেছিল শহরের এক নামী হাসপাতালের বিজ্ঞাপনে লেখা- “তোমার ছুটি, আমার নয়।” হাসি পায় তার। বালিগঞ্জ স্টেশন থেকে হেঁটে সে পৌঁছোয় ত্রিকোণ পার্ক। সেখানে দু’বাড়ি। তারপর চেতলা। সেখানে তিনবাড়ি। এ কয়দিন তার কত কাজ! সবাই বেড়াতে বেরোবে। ভালোমন্দ খাবে। এ বাড়ি পোলাও মাংস তো ও বাড়ি নিরামিষ খিচুড়ি ভাজা চাটনি। এ বাড়ি মাছের কালিয়া ডাল তরকারি ভাত তো ও বাড়ি পেঁপে আলু দিয়ে মুরগির পাতলা ঝোল। সব করে ঢেকে রাখতে হবে টেবিলে। তাদের ফিরতে দেরি আছে। মেয়েটি যখন রাত নয়টা নাগাদ ক্লান্ত শরীরটা টেনে তিন কিলোমিটার হেঁটে গিয়ে ট্রেনে ওঠে, তখন উল্টোদিকের ট্রেনে ভিড় যেন ফেটে পড়ে। রাতের বেলা সবাই শহরে ঠাকুর দেখতে আসছে যে। “তোমার ছুটি, আমার নয়।” ফাঁকা ট্রেনে তখন তার প্রথম জলের ফোঁটাটি বেয়ে নামে গালে। 

যবে পুজো শেষ হবে, কালীপুজোর জামা নয়, ছেলেটির বাবা পয়সা গুনতে বসবে নিজের নেশার জন্য। ছেলেটি যবে জানবে কালীপুজোর নতুন জামা মিথ্যে, আরেকটু বড় হবে সে। যুবকটি টিয়াসবুজ শাড়ি নয়, ভাবতে বসবে বাড়িভাড়ার কথা। বউকে না হয় মানিয়ে নেবে নিশিশয্যায়, যেমন করে রোজ ঢাকা পড়ে কত শত অপূর্ণতার গল্প। পিছল বাঁশ থেকে নেমে পয়সা নয়, অন্য মানুষটি মেদিনীপুর ফিরবে দুটি প্রৌঢ় মানুষের কয়দিনের মাছ ভাতের স্বপ্ন ট্যাঁকে নিয়ে। পিছলে পড়েনি সে এ বছর। মেয়েটিও জানে, মাছ মাংস তরকারি পোলাও খিচুড়ি ডাল চাটনি সব বাবুদের জোটে। সে চায় শুধু চাউনি আর কনুই আর স্পর্শ এড়িয়ে ঘরে পৌঁছোতে আরো একটি রাত। 

ভেসে যায় সোনার আলোয় শরতের আকাশ। ভেসে যায় থরে বিথরে ঢেকে রাখা খাবারে বাতানুকুল খাবার টেবিল। ভেসে যায় আলোর বন্যায় উৎসবের রাতের শহর। ভেসে যায় আনন্দের সাগরে কত শত মেতে ওঠা মানুষের মন। চলে যায় উৎসবের দিন। ভেসে  যায় নদীজলে প্রতিমার সিঁদুরলেপা মুখ। তারই সাথে ভেসে যায়, ডুবে যায় কত কত জীবনের গল্প। রোজ যে জীবনের গল্প লেখা হয় এ শহরের অলিগলিতে, যা মিশে যায় চোখের জলে- ঠিক যেমন মেশে নদীজলে প্রতিমার মাটি। ডুবে যায় সে সব চোখের জল  বেঁচে থাকবার অদম্য আগ্রহে, যা আমরা এ শহরের উৎসবের কলতানে শুনতে পাই কই? 

তবুও পুজো আসে। তবুও আলো জ্বলে। তবুও বাদ্যি বাজে। তবুও নীলকন্ঠ পাখি ওড়ে। লেখা হয় এ জীবনযুদ্ধে কত কত মানুষের কত কত বিজয়ের গল্প। দশমী বিজয়া হয়।

Popular posts from this blog

MSME-DFO, Kolkata organized Vendor Development Programme for the MSME Sector at Indian Institute of Packaging, Kolkata

Nephrocare India celebrates its second anniversary by organizing a Walkathon – ‘A walk for your kidney’ and spread awareness for better Kidney care

Karnataka Tourism: A Cultural Odyssey Unveiled at IITM Hyderabad 2023